Homeজাতীয়আপন মহিমায় উজ্জ্বল

আপন মহিমায় উজ্জ্বল

আমি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করেছি অসংখ্যবার কারণে বা অকারণে।
কারণ থাকায় দেখা করলে মনে করতে হবে, পারস্পরিক স্বার্থ আছে। অকারণে দেখা করলে বুঝতে হবে একে অপরের পছন্দের এবং ভালোবাসার মানুষ। যেমন আমি আমার ভাইবোনদের সঙ্গে দেখা করতে যাই তাদেরকে ভালোবাসি বলে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কেবল দু’একবার ছাড়া সব সাক্ষাৎকারই ছিল অকারণে।

কারণ থাকায় যে দু’একবার দেখা করেছি, তার থেকে দুটি উদাহরণ দিচ্ছি:
১৯৮২ সালের আগস্ট মাসের এক বা দুই তারিখ। তখনকার সাপ্তাহিক ‘সচিত্র সন্ধানী’ পত্রিকা অফিসে গেলাম। মালেকা আপা তখন ওই পত্রিকার সম্পাদক। তার সঙ্গে দেখা হলে তিনি বললেন, ১৫ আগস্টের ওপর একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করবেন। ওই বিশেষ সংখ্যায় শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার অর্থাৎ বক্তব্যই হবে প্রধান বিষয়। এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য বারবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে পারছি না।

আমি মালেকা আপাকে বললাম, চলুন যোগাযোগ না করেই যাই। আমিও যাব আপনার সঙ্গে।
শেখ হাসিনা তখন ৩২ নম্বর রোডের বাসায় থাকতেন। ওখানে গিয়ে তাঁকে বাসায়ই পেলাম। মালেকা আপা শেখ হাসিনার বক্তব্য রেকর্ড করছিলেন। শেখ হাসিনা একটানা ৪০-৪৫ মিনিট খুব প্রাঞ্জল এবং স্বচ্ছভাবে কথা বলছিলেন। এমন দীর্ঘ সময় তাঁকে কথা বলতে দেখে ভাবছিলাম তিনি কতটা স্বচ্ছভাবে চিন্তা করতে পারেন! স্বচ্ছভাবে চিন্তা না করতে পারলে স্বচ্ছভাবে কথাও বলা যায় না।

॥ দুই ॥
১৯৯২ সাল।
আমার বড় ছেলে অঞ্জন সাত্তার তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ডাক্তারি পাস করে বাংলাদেশে আসে। ওই সময় ‘বাংলাদেশ ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন’ নামের বিএনপিপন্থি একটি সংগঠন ছিল। তখন বিএনপি দলটির অন্যতম উপদেষ্টা ডা. জাহিদ হোসেন ছিলেন ওই সংগঠনটির প্রধান। তিনি ঘোষণা দিলেন, যারা বিদেশ থেকে ডাক্তারি পাস করে এসেছে, তাদেরকে বাংলাদেশের কোনো হাসপাতালে ইন্টার্নিশিপ করতে দেওয়া হবে না। আমার ছেলে কোনো হাসপাতালে ইন্টার্নিশিপ করার সুযোগ পেল না। কিন্তু বিএনপিপন্থিদের কোনো সমস্যা হচ্ছিল না। তারা সহজেই বিভিন্ন হাসপাতালে ইন্টার্নি করার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছিল।

আমার ছেলে আমাকে বলল, মিটফোর্ড মেডিক্যালে ছাত্র পরিষদে ছাত্রলীগ এবং ছাত্রদলের সংখ্যা সমান সমান। চলো হাসিনা আপার কাছে। তিনি যদি কাউকে দিয়ে বলিয়ে দেন, তবে মিটফোর্ডে আমার ইন্টার্নিশিপ করার সুযোগ হতে পারে।
তখন শেখ হাসিনা সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী। বাস করতেন বেইলি রোডের সরকারি বাসভবনে।
একদিন সকাল দশটায় বেইলি রোডে গেলাম। শেখ হাসিনা গৌরিপুরে একটি সভায় যোগদান করতে যাবেন। তাঁর সঙ্গে যাবেন যে সব নেতা তারা ভবনের নিচতলায় অপেক্ষমাণ ছিলেন। অঞ্জন আর আমিও তাদের সঙ্গে শামিল হলাম এবং ভাবছিলাম কখন শেখ হাসিনা নিচে নেমে আসবেন?
তখন আমেরিকার প্রেসিডেন্টশিয়াল নির্বাচনের প্রজেকশন মিটিং চলছিল। শেখ হাসিনা ভবনের উপরতলায় বসে ওই প্রজেকশন মিটিং দেখছিলেন।
প্রায় একঘণ্টা পর তিনি নিচে নেমে এলেন। তাঁর সঙ্গে গৌরিপুর যাবেন যে সব নেতা তারা নিজ নিজ গাড়ির দিকে চলতে শুরু করলেন।

শেখ হাসিনা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসতেই অঞ্জন আর আমি গিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়ালাম। তিনি আমাদের জিগ্যেস করলেন, কি বিষয়?
তাঁকে অঞ্জনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে বললাম, ও শেখ রাসেলের সঙ্গে ইউনিভার্সিটি-ল্যাব স্কুলে এক সঙ্গে একই শ্রেণিতে পড়ত। ওরা খুব ভালো বন্ধু ছিল। এরপর অঞ্জনের সমস্যার কথা বিস্তারিত করে বলে বললাম, আপনি যদি কোনো মেডিক্যাল হাসপাতালে ওর ইন্টার্নিশিপের ব্যবস্থা করে দেন, তবে খুব ভালো হয়।
শেখ হাসিনা আমাদেরকে আশ্বস্ত করে বললেন, অবশ্যই কিছু একটা করে দেওয়া যাবে। এই বলে তিনি এক দৌড়ে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় গেলেন এবং খুব দ্রুতই নেমে এলেন, তাঁর দুই হাতে ছিল দুই হাঁড়ি মিষ্টি। ওই মিষ্টি অঞ্জনের হাতে দিয়ে বললেন, গত পরশু দিন রাজবাড়ী গিয়েছিলাম। ওখানকার লোকজন অনেক মিষ্টি দিয়েছিল।
ভাবছিলাম, তিনি নিজে দৌড়ে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে গিয়ে মিষ্টির হাঁড়ি না আনলেও পারতেন। অন্য কাউকে নির্দেশ দিয়ে যেতে পারতেন এটা করার জন্য। কিন্তু অন্য কাউকে দিয়ে মিষ্টি দেওয়া আর নিজের হাতে দেওয়ার মধ্যে যে অনেক পার্থক্য, তা প্রিয় পাঠককে অবশ্যই বোঝাতে হবে না। এই যে নিজে দৌড়ে গিয়ে মিষ্টি নিয়ে আসলেন, এতেই বোঝা যায় অন্য রাজনীতিবিদদের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য কোথায়! বুঝলাম শেখ হাসিনার মতো হতে হলে বঙ্গবন্ধুর কন্যা হতে হবে।
শুধু মিষ্টি দেওয়া নয়, তিনি অঞ্জনের সমস্যারও সমাধান করে দিয়েছিলেন।

॥ তিন ॥
এবার অকারণে শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করা নিয়ে দুটি উদাহরণ দেব:
একদিন ধানম-ির পাঁচ নম্বর রোডের কাছ দিয়ে বাসায় ফিরছিলাম। শেখ হাসিনা তখন সংসদ থেকে তাঁর দলের সদস্যদের নিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন। তাই তিনি অবস্থান করছিলেন তাঁর পাঁচ নম্বর রোডের বাড়িতে। আমি মনে করলাম, শেখ হাসিনার সঙ্গে একটু দেখা করে যাই। আমার বাসা ছিল কাছেই।
শেখ হাসিনার পাঁচ নম্বর রোডের বাসায় গিয়ে একজনকে বললাম, আপনি গিয়ে শেখ হাসিনাকে একটু বলবেন কি, ক্যাপ্টেন সাত্তার আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়। যাকে এই অনুরোধ করলাম, তিনি বললেন, নেত্রী সেই সকাল বেলায় বাসা থেকে বেরিয়ে এক ঘণ্টা আগে বাসায় ফিরেছেন। কক্সবাজারসহ দুই জায়গায় মিটিং করেছেন। বিকেলে ঢাকায় ফিরে এসে ধানম-ির আওয়ামী লীগ অফিসে গিয়েছিলেন। এখন কি কারও সঙ্গে তিনি দেখা করবেন?

আমি তাকে আবার অনুরোধ করলাম, গিয়ে বলুন আমার নাম।
তিনি ওপরে গিয়ে ফিরে এসে বললেন, চলুন আমার সঙ্গে, আমি পৌঁছে দিচ্ছি।
ওপরে গিয়ে দেখলাম, নেত্রী ছোট একটা রুমে বসে ল্যাপটপে কি যেন টাইপ করছেন। আমাকে বললেন, বসেন। তারপর বললেন, ল্যাপটপ চালানো শিখছি। কাকে যেন বললেন, দুই কাপ চা এবং কিছু কেক নিয়ে আসতে।
আমি শেখ হাসিনাকে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। চট্টগ্রাম-কক্সবাজারে দুটি মিটিং করে আওয়ামী লীগ অফিসে ঘণ্টা দুয়েক কাটিয়ে বাসায় ফিরেছেন। কিন্তু তাঁর চোখেমুখে কোনো ক্লান্তির ছাপ নেই, আছে বেশ প্রশান্তির ছাপ। প্রশান্তি বেশ সংক্রামক। শেখ হাসিনার প্রশান্তি আমাকেও ছুঁয়ে গেল। মনে হলো তাঁর কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। ওই দিন তাঁর সঙ্গে কি কথা হয়েছিল, এতদিন পরে তা আর মনে নেই। আমি মনে বেশ প্রশান্তি নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম।

॥ চার ॥
১৯৯০ সালে আমার কন্যা মাধুরী এবং আমি ক্যাপ্টেন শাহাবের বনানীর বাসায় গিয়েছিলাম। সেখান থেকে সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরছিলাম। তখন শেখ হাসিনা ড. ওয়াজেদের মহাখালীর সরকারি কোয়ার্টারে থাকতেন। মহাখালীর কাছাকাছি আসতেই মাধুরী বলল, বাবা চলো, হাসিনা আপুর সঙ্গে দেখা করে যাই।
আমার মেয়ে মাধুরীও ইউল্যাব স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ত। শেখ রাসেল এবং আমার ছেলে পড়ত চতুর্থ শ্রেণিতে। রাসেলের সঙ্গে মাধুরীরও ঘনিষ্ঠতা ছিল।

আমি এবং আমার কন্যা যখন আওয়ামী লীগ নেত্রীর বাসায় পৌঁছলাম তখন ড. ওয়াজেদ বাসায় ছিলেন না। একটা কাজের ছেলেকে দেখতে পেলাম। তাকে শেখ হাসিনার কথা জিগ্যেস করলাম। ছেলেটি বলল, নেত্রীর শরীর ভালো নেই। ওপরের ঘরে শুয়ে আছেন। ছেলেটি আমাকে চিনত। শেখ হাসিনার অনুমতি নিয়ে এসে সে আমাদের ওপরের ঘরে নিয়ে গেল।
দেখতে পেলাম গরমের দিনেও একখানা কাঁথায় শরীর পেঁচিয়ে হাসিনা বিছানায় শুয়ে আছেন। আমাদের দেখে, মাথাটা তুলে একটা বালিশে ঠেস দিয়ে বসলেন। বললেন, আজ দুদিন ধরে সর্দিজ্বরে ভুগছি। ডা. মহিউদ্দিন (আওয়ামী লীগ নেতা) এসেছিলেন। প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়ে গেছেন। এই বলে নিচের কাজের ছেলেটিকে চা-বিস্কুট নিয়ে আসতে বললেন। আমার কন্যার সঙ্গে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিলাম।
আমার মেয়ে বলল, আমি আগামীকাল আমেরিকায় চলে যাচ্ছি। ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। শেখ হাসিনা আমার মেয়েকে আশীর্বাদ করলেন।

ওই দিনের পর বারবার চিন্তা করেছি, কী অদম্য মনোবল। কী অবস্থা থেকে শত্রুদের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে নিজের দলটাকে এবং দেশটাকে কোন্ অবস্থানে একক প্রচেষ্টায় তিনি নিয়ে এসেছেন এবং বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করে চলেছেন। বিস্ময়কর বিষয়!
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শুভ জন্মদিনে রইল আমার আন্তরিক গভীর শ্রদ্ধা এবং অফুরন্ত ভালোবাসা। মহান সৃষ্টিকর্তা যেন তাঁকে শারীরিক ও মানসিক সুস্থ রাখেন।

লেখক : ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার, বীরপ্রতীক, পাইলট, কিলোফ্লাইট

সম্পর্কিত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন