প্রেক্ষাপট- নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে বিচারিক কার্যক্রম স্থগিতের আহ্বান জানিয়ে ১০৫ জন নোবেল বিজয়ীসহ ১৭৬ জন বিশ্বনেতা বিবৃতি দিয়ে চিঠি দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। চিঠিটি নোবেল বিজয়ীসহ বিশ্বের প্রভাবশালী নেতারা লিখলেও, রাষ্ট্র কাঠামোর নানা প্রশ্নে এই চিঠি প্রশ্নবিদ্ধ।
চিঠি প্রকাশ- বিস্ময়করভাবে লক্ষ্য করা যায়, ১০৫ জন নোবেল বিজয়ীসহ ১৭৬ জান বিশ্বনেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে যে চিঠিটি লিখেছেন, তা প্রকাশিত হয়েছে ওয়ার্ডপ্রেসের একটি সাবডোমেইনে। Protect Yunus নামের এই সাবডোমেইনটি ঘেঁটে ড. ইউনূসের আন্তর্জাতিক মহলের যোগাযোগ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। ওয়ার্ডপ্রেসের ব্লগে থাকা একই নামের একটি টুইটার একাউন্টে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ফলোয়ারের সংখ্যা মাত্র ৬৩জন। এমনকি ব্লগপোস্টটি যে টুইটারে পোস্ট আকারে দেওয়া হয়েছে, সেখানেও প্রতিক্রিয়া মাত্র ৫টি, রি-টুইট মাত্র ২টি। প্রশ্ন হলো, এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের এই চিঠিটি ওয়ার্ডপ্রেসের একটি সাবডোমেইনেই প্রচার করতে হলো? তাছাড়া টুইটার রিঅ্যাকশন থেকে বোঝা যায়, চিঠিটির বিষয়ে খুব বেশি আগ্রহ নেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের।
চিঠির বক্তব্যের অসঙ্গতিসমূহ- গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নাম থাকলেও চিঠির ভাষা পড়েই বোঝা যায়, সংবিধান জানা কোনো ব্যক্তি এই চিঠি লেখেননি বা চিঠির বক্তব্য তারা পড়ে দেখেননি। যদিও বাংলাদেশের বিচারিক আওতাধীন না হওয়ায়, বাংলাদেশের আইন মানার কোনো বাধ্যবাধকতা তাদের নেই, তবুও প্রশ্ন থেকে যায়, বাংলাদেশের আইনের কতটুকু জেনে এই চিঠিটি লেখা হয়েছে?
• চিঠির প্রাপক: গোড়াতেই গলদ
শুরুতেই আসা যাক চিঠিটি কাকে পাঠানো হয়েছে সে বিষয়ক আলোচনায়। পুরো চিঠি পড়ে এটা জানা যায় যে, এই ১৭৬ জন গণ্যমান্য ব্যক্তির মূল বক্তব্য হলো ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে বিচারিক কার্যক্রম যেন বন্ধ করা হয়। কিন্তু চিঠিটি পাঠানো হয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট, যিনি রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের প্রধান। বাংলাদেশে ২০০৭ সালেই ঐতিহাসিক মাসদার হোসেন মামলার রায়ের প্রেক্ষিতে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচারবিভাগ আলাদা হয়ে গেছে। সুতরাং চিঠির চতুর্থ অনুচ্ছেদের দ্বিতীয় বাক্যে যে স্বাক্ষরদাতাগণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে ‘বিচারিক প্রক্রিয়া বন্ধের আবেদন’ করেছেন, তা কি আদৌ তাঁর এখতিয়ারে পড়ে?
• ড. ইউনূসের মানবাধিকার আছে, শ্রমিকদের নেই?
চিঠির তৃতীয় অনুচ্ছেদে জানানো হয়েছে, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে চলমান মামলাকে স্বাক্ষরদাতাগণ মানবাধিকারের বিরুদ্ধে হুমকি মনে করছেন। মানবাধিকারের এমন কাস্টমাইজ সংজ্ঞা অবশ্য এর আগেও তারা দিয়েছেন। যে ১৭৬ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এতে স্বাক্ষর করেছেন, ধরে নেওয়া যেতে পারে, তারা ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে চলমান মামলা সম্পর্কে অবগত এবং মামলার নথিপত্রও দেখেই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এটি ঠিক হচ্ছে না। তাহলে প্রশ্ন জাগে, মামলার নথিতে থাকা প্রতারণার স্বীকার শ্রমিকদের দুর্দশা কি তাঁদের চোখ এড়িয়ে গেছে? দীর্ঘ দিন ধরে বঞ্চিত এই শ্রমিকদের বিষয়ে তাদের মতো বিবেকবান মানুষের কি কোনো বক্তব্যই নেই?
• অপরাধীর বিরুদ্ধে মামলা চালানো কি বিচারিক হয়রানি?
তৃতীয় অনুচ্ছেদের আরেকটি ব্ক্তব্য কোনো দেশের আইনি যুক্তিতেই খাটে না। স্বাক্ষরদাতাগণ জানিয়েছেন যে, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে তারা চিন্তিত এবং “তারা মনে করেন” যে, ড. ইউনূস বিচারিক হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
প্রথম কথা হচ্ছে, পৃথিবীর যে কোনো দেশেই আইন সকলের জন্য সমান। কোনো অভিযোগ থাকলে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে তার সামাজিক, রাষ্ট্রীয় বা আন্তর্জাতিক কোনো অবস্থানই বিচার করে না আদালত। এটাই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রথম শর্ত। ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে যে আইনি কার্যক্রম চলমান, তা সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই চলছে। শ্রম আইন লঙ্ঘন, কর ফাঁকিসহ বেশ কয়েকটি সংবেদনশীল মামলার আসামী ড. ইউনূস। সুতরাং তাকে টার্গেট করা হয়েছে, এ বক্তব্যের কোনো প্রমাণ তারা দিতে পারেননি।
দ্বিতীয়ত, চিঠিতে ‘বিচারিক হয়রানি’ কথাটি লেখার সময় তারা উল্লেখ করেননি, কীসের প্রেক্ষিতে তারা এ ধরনের সিদ্ধান্তে এলেন? ড. ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক ও গ্রামীণ টেলিকমের ফাঁদে পড়ে হাজার হাজার মানুষ সর্বশান্ত হয়েছেন। তাদের কি বিচার পাওয়ার কোনো অধিকার নেই? তাছাড়া পুরো চিঠিতে এমন কোনো ইঙ্গিত নেই যে, তারা মামলার সকল নথিপত্র পর্যালোচনা করে স্বাক্ষর করেছেন। তাহলে তারা কী করে বুঝলেন যে, ইউনূসকে বিচারিক হয়রানি করা হচ্ছে?
• বিচারাধীন বিষয় ও বিচারক সম্পর্কে মন্তব্য
চিঠির চতুর্থ অনুচ্ছেদে স্বাক্ষরদাতাগণ যে মন্তব্য করেছেন, বাংলাদেশের আইনে তা আদালত অবমাননার শামিল। অনুচ্ছেদের দীর্ঘ প্রথম বাক্যের এক অংশে বলা হয়েছে, “followed by a review of the charges by a panel of impartial judges” অর্থাৎ বর্তমান বিচারক প্যানেলকে তারা নিরপেক্ষ মনে করছেন না। যদি ধরেও নিই পর্যাপ্ত গবেষণার মাধ্যমে মামলার গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণপূর্বক তারা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন, তাহলে প্রশ্ন থাকে- তারা কি জানেন না বাংলাদেশের আইনে এ ধরনের মন্তব্য আদালত অবমাননার শামিল? যেখানে আমাদের সংবিধানের ষষ্ঠ ভাগের ১ম পরিচ্ছেদের ৯৪(৪) ধারায় রয়েছে, “এই সংবিধানের বিধানাবলী-সাপেক্ষে প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারক বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন”, সেখানে তারা কীসের ভিত্তিতে দাবি করেছেন বর্তমান বিচারকগণ স্বাধীন নয়? এখন বাংলাদেশ থেকে কেউ যদি বলে থাকেন, মার্কিন আদালতে যে ট্রাম্পের বিচার হচ্ছে, তা নিরপেক্ষ আইনজীবী দ্বারা হচ্ছে না, তাহলে কি সেটা যুক্তিসঙ্গত হবে?
ড. ইউনূস ও ডেমোক্রেট আধিপত্য-
১৭৬ জন স্বাক্ষরদাতার মধ্যে ১০৫ জন নোবেল বিজয়ী। কিন্তু আশ্চর্যের ঘটনা হলো, এই ১০৫ জনের মধ্যে ৬৪ জনই ডেমোক্রেটদের শাসনামলে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। অর্থাৎ স্বাক্ষরকারী নোবেল বিজয়ীদের মধ্যে ৬১% ডেমোক্রেট আমলে নোবেল বিজয়ী। ডেমোক্রেটদের সঙ্গে ড. ইউনূসের সম্পর্ক নানা কারণেই বেশ ঘনিষ্ঠ। হিলারি ক্লিনটনের নির্বাচনি প্রচারণাতেও ইউনূস মোটা অংকের ফান্ড দিয়েছিল। স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে যারা নোবেল বিজয়ী, প্রশ্ন হচ্ছে ডেমোক্রেটদের প্রভাবেই কি তারা স্বাক্ষর করেছে?