Homeঅর্থনীতিচাল নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই

চাল নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই

ভারতসহ বিভিন্ন দেশ চাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও বাংলাদেশের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। গত মৌসুমে বোরো এবং আমন ফলন ভালো হওয়ার পাশাপাশি আগেভাগে আমদানির কারণে দেশের খাদ্য পরিস্থিতি স্বস্তিদায়ক অবস্থায় রয়েছে। বিশ্ববাজারে চালের দাম বাড়লেও দেশের বাজার স্থিতিশীল রয়েছে।

বাজারে পর্যাপ্ত চাল রয়েছে। আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনো চিন্তা নেই। এরপর আমন ফসল উঠবে। দেশবাসী আমনের দিকে তাকিয়ে আছে। আমনের ফলন ভালো হলে এই মুহূর্তে চাল আমদানির প্রয়োজন পড়বে না।

এ বিষয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, দেশে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুত রয়েছে। আমনের ফসলও ভালো দেখা যাচ্ছে। এ মুহূর্তে চাল আমদানির প্রয়োজন নেই। তিনি বলেন, বিশ্ব বাজার নিয়ে আমরা সচেতন। যে কোনো পরিস্থিতি দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবিলার জন্য আমাদের পূর্ণাঙ্গ মনিটরিং আছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশের বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণ চাল রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বাজারও স্থিতিশীল রয়েছে। সরকারিভাবেও কঠোরভাবে বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে। এরপরও কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সুযোগ বুঝে সিন্ডিকেট তৈরি করে বাজার অস্থিতিশীল করার চেষ্টায় আছে। কিন্তু সরকারের কঠোর মনিটরিংয়ের কারণে তারাও কোণঠাসা হয়ে রয়েছে।

দেশের খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে খাদ্যসচিব মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, আমরা আমন ফসলের দিকে তাকিয়ে আছি। আমনের ফলন ভালো হলে আপাতত কোনো সমস্যা থাকবে না। তবে সব মিলে ২০২৪ সালে সতর্ক থাকতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের গুদামে যথেষ্ট পরিমাণে চাল আছে। আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত চাল নিয়ে আমাদের কোনো চিন্তা নেই। মিয়ানমারে আগামী অক্টোবরে নতুন চাল উঠবে। তখন দাম কমতে পারে।

রাশিয়া গমের যে দাম চাইছে, আমরা আন্তর্জাতিক দরপত্রে তার চেয়ে কম দাম পাচ্ছি। যে কারণে বিকল্প হিসেবে আমরা দরপত্রের মাধ্যমে চাল-গম কেনার কথা চিন্তা করছি। তিনি বলেন, কোনো কারণে আমনের ফলন কম হলে অতিরিক্ত দামে চাল আমদানি করতে হবে সরকারকে। বিশ্ববাজারে চালের দাম বাড়তি। ভারতও চাল রপ্তানিতে শুল্ক বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে সরকারকে বাড়তি চাপ মাথায় নিতে হচ্ছে।

বিশ্ববাজারে চালের দাম বেড়ে গেছে। এতে কম দামে চাল ও গম কেনার সুযোগ থাকছে না। ভারত চাল রপ্তানিতে শুল্ক বাড়িয়েছে। মিয়ানমার চাল রপ্তানিতে বেশি দাম চাইছে। দাম বেড়ে গেছে থাইল্যান্ডেও। আর গম আমদানিতে বেশি দাম চাইছে রাশিয়া। সম্প্রতি সরকারের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) আওতায় রাশিয়া ও মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় দুটি সংস্থার সঙ্গে চাল ও গম আমদানির বিষয়ে সম্প্রতি আলোচনায় বসেছিল বাংলাদেশের খাদ্য মন্ত্রণালয়। এতে রাশিয়ার পক্ষ থেকে গম ও মিয়ানমারের পক্ষ থেকে চালের দাম অনেকটা বেশি চাওয়া হয়। এ কারণে দুটি বৈঠকই কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়া শেষ হয়।

ঝুঁকিমুক্ত থাকতে সরকার চলতি বছরে সাত লাখ টন গম ও পাঁচ লাখ টন চাল আমদানি করতে চায়। বেসরকারি খাতে মাঝেমধ্যে চাল আমদানি হয়। গম আমদানি হয় নিয়মিত। কোনো কোনো দেশের বিধিনিষেধ ও দাম বেশি চাওয়ার কারণে খাদ্যের বিশ্ববাজার পরিস্থিতি এখন অনুকূল নয়। তবে বাংলাদেশ সরকারের হাতে এখনো খাদ্যের ভালো মজুত আছে।

বাংলাদেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে তিন কোটি ৮০ লাখ টন চাল উৎপাদিত হয়েছে। সরকারি হিসাবে, চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু প্রতিবছরই সরকারি ও বেসরকারিভাবে কিছু কিছু চাল আমদানি হয়। আর গমের চাহিদার বড় অংশই আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারি ও বেসরকারি খাতে ১০ লাখ ৫৬ হাজার টন চাল ও প্রায় ৩৯ লাখ টন গম আমদানি হয়েছে।

চাল ও গমের বড় উৎস ছিল ভারত। নিজেদের বাজার সামলাতে গত মে মাসে ভারত গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। গম মাস জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে দেশটি আতপ চাল (নন-বাসমতি হোয়াইট রাইস) রপ্তানি নিষিদ্ধ করে। গত শুক্রবার ভারতের পক্ষ থেকে সিদ্ধ চাল রপ্তানিতে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়, যা কার্যকর থাকবে ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত।

আট মাস আগে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত বাণিজ্যমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি আট ধরনের নিত্যপণ্যে কোটা চেয়ে ভারতের কাছে প্রস্তাব দেন। তখন ভারতের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গয়ালের পক্ষ থেকে লিখিত প্রস্তাবের পরামর্শ দিয়ে এ বিষয়ে সম্মতিও জানানো হয়। বাংলাদেশ বিষয়টি লিখিতভাবে দিয়েছিল। ভারতের জয়পুরে জি-২০ বাণিজ্য ও বিনিয়োগবিষয়ক বৈঠকের এক ফাঁকে গত শুক্রবার অনুষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় ভারতের পীযূষ গয়ালকে পণ্যগুলো সরবরাহের প্রক্রিয়া দ্রুত করার অনুরোধ জানান টিপু মুনশি।

এদিকে সম্প্রতি বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক খবরে বলা হয়, অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাল রপ্তানিতে সাময়িক বিধিনিষেধ আরোপের পরিকল্পনা করছে মিয়ানমার। শীঘ্রই যা ঘোষণা করা হতে পারে। কৃষ্ণসাগর হয়ে ইউক্রেনের শস্য রপ্তানির জন্য জাতিসংঘ-সমর্থিত একটি চুক্তি থেকে গত মাস জুলাইয়ে বেরিয়ে যায় রাশিয়া। এর পাশাপাশি বিভিন্ন দেশ খাদ্য রপ্তানিতে কড়াকড়ি আরোপ করায় আমদানিকারক দেশগুলো বিপাকে পড়েছে।

রয়টার্সের তথ্য নিয়ে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) তৈরি করা ২৪ আগস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, থাইল্যান্ডে পাঁচ শতাংশ ভাঙা আপত চালের দাম উঠেছে প্রতি টন ৬০৯ মার্কিন ডলারে, যা এক মাস আগের তুলনায় ১৪ শতাংশ বেশি। এক বছর আগের তুলনায় এখনকার দর বেশি প্রায় ৩৮ শতাংশ। অবশ্য এক মাসে যুক্তরাষ্ট্রের গমের দাম ১৮ শতাংশ কমে প্রতি টনে ২৭৩ ডলারে নেমেছে।

বাংলাদেশ সাধারণত ভারত, ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে গম আমদানি করে। রয়টার্স এক প্রতিবেদনে জানায়, রাশিয়ায় ভালো ফলনের পূর্বাভাসে দেশটিতে গমের দাম কমছে। সেপ্টেম্বরে সরবরাহের ক্ষেত্রে ১২ শতাংশ আমিষসমৃদ্ধ গমের জাহাজভাড়া ছাড়া (এফওবি) প্রতি টনে দর নেমেছে ২৪৫ ডলারে।

মিয়ানমার সরকারের চাল রপ্তানিকারক সংস্থা মিয়ানমার রাইস ফেডারেশনের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে গত মঙ্গলবার বৈঠক করে খাদ্য মন্ত্রণালয়। তারা প্রতি টন চালের দাম ৬০০ মার্কিন ডলারের বেশি চায়। খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাদের বলা হয়েছে, এত বেশি দামে চাল কেনা সম্ভব নয়।
রাশিয়া থেকে পাঁচ লাখ টন গম আমদানির বিষয়ে ১৬ আগস্ট বৈঠক হয় দেশটির রাষ্ট্রীয় সংস্থা প্রডিনটর্গ ও তাদের প্রতিনিধি বাংলাদেশের ন্যাশনাল গ্রুপের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বৈঠকে প্রতি টন গমের দাম ৩৩০ ডলার করে চায় রাশিয়া। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষ থেকে গমের দাম আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি বলে মন্তব্য করা হয়। রাশিয়ার সংস্থা দাম কমাতে রাজি হয়নি। ফলে বৈঠক সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়।

খাদ্য অধিদপ্তর চলতি মাসের শুরুতেই ৫০ হাজার টন করে এক লাখ টন গম আমদানির দুটি আন্তর্জাতিক দরপত্র ডাকে। সেখানে একটিতে ২৯৩ ডলার ও আরেকটিতে ৩০৪ ডলার দর পাওয়া যায়। খাদ্য অধিদপ্তরের হাতে এখন প্রায় ১৯ লাখ টন চাল ও গম মজুত আছে। এই চাল ও গম সরকার সাধারণ রেশন, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি এবং খোলা বাজারে বিক্রি (ওএমএস) কর্মসূচিতে ব্যয় করে। বাজারে কেনাবেচা হয় দেশে উৎপাদিত ও বেসরকারিভাবে আমদানি করা চাল ও গম।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, ঢাকার খুচরা বাজারে এখন এক কেজি মোটা চালের দাম ৪৮ থেকে ৫০ টাকা, যা এক বছর আগের তুলনায় ১৩ শতাংশ কম। খোলা আটার দামও মোটা চালের সমান। দেশের বাজারে দাম এখনো কম থাকলেও বিশ্ববাজার পরিস্থিতি ভালো নয়।

সম্পর্কিত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন